অধ্যায় – ০৪ ( সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসন )
১। সালোকসংশ্লেষণ কাকে বলে?
উত্তরঃ সবুজ উদ্ভিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যে এরা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) এবং পানি থেকে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাদ্য তৈরি করে। সবুজ উদ্ভিদে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য তৈরি হওয়ার এ প্রক্রিয়াকে সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) বলা হয়।
সালোকসংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হলো: ক্লোরোফিল, আলো, পানি এবং কার্বন ডাই অক্সাইড। সালোকসংশ্লেষণ একটি জৈব রাসায়নিক (biochemical) বিক্রিয়া, যেটি এরকম:
পাতার মেসোফিল টিস্যু সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার প্রধান স্থান। স্থলজ সবুজ উদ্ভিদ মাটি থেকে মূলের মাধ্যমে পানি শোষণ করে পাতার মেসোফিল টিস্যুর ক্লোরোপ্লাস্টে পৌঁছায় এবং স্টোমাটা বা পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে বায়ু থেকে CO2 গ্রহণ করে, যা মেসোফিল টিস্যুর ক্লোরোপ্লাস্টে পৌঁছে। জলজ উদ্ভিদ পানিতে দ্রবীভূত CO2 গ্রহণ করে। বায়ুমণ্ডলে 0.03% এবং পানিতে 0.3% CO2 আছে, তাই জলজ উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণের হার স্থলজ উদ্ভিদ থেকে বেশি।
২। ফটোফসফোরাইলেশন কাকে বলে ?
উত্তরঃ ক্লোরোফিল অণু আলোকরশ্মির ফোটন (photon) শোষণ করে এবং শোষণকৃত ফোটন থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ADP (অ্যাডিনোসিন ডাইফসফেট) অজৈব ফসফেট (Pi = inorganic phosphate)-এর সাথে মিলিত হয়ে ATP তৈরি করে। ATP তৈরির এই প্রক্রিয়াকে ফটোফসফোরাইলেশন (photophosphorylation) বলে।
৩। আলোক নিরপক্ষ পর্যায় সম্পর্কে লিখুন।
উত্তরঃ সবুজ উদ্ভিদে CO2 বিজারণের তিনটি গতিপথ শনাক্ত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ক্যালভিন চক্র, হ্যাচ ও স্লাক চক্র এবং ক্রেসুলেসিয়ান এসিড বিপাক বা CAM প্রক্রিয়া।
(i) ক্যালভিন চক্র বা C3 গতিপথ (Calvin cycle বা C3 cycle): CO2 আত্তীকরণের এ গতিপথকে আবিষ্কারকদের নামানুসারে ক্যালভিন–বেনসন ও ব্যাশাম চক্র বা সংক্ষেপে ক্যালভিন চক্র বলা হয়। ক্যালভিন তার এ আবিষ্কারের জন্য 1961 সালে নোবেল পুরস্কার পান। অধিকাংশ উদ্ভিদে এই প্রক্রিয়ায় শর্করা তৈরি হয় এবং প্রথম স্থায়ী পদার্থ 3-কার্বনবিশিষ্ট ফসফোগ্লিসারিক এসিড বলে এই ধরনের উদ্ভিদকে বলে C3 উদ্ভিদ।
(ii) হ্যাচ ও স্লাক চক্র বা C4 গতিপথ (Hatch and Slack cycle বা C4 cycle): অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানী M.D. Hatch ও C.R. Slack (1966 সালে) CO2 বিজারণের আর একটি গতিপথ আবিষ্কার করেন। এই গতিপথের প্রথম স্থায়ী পদার্থ হলো 4 কার্বনবিশিষ্ট অক্সালো এসিটিক এসিড তাই, একে C4 গতিপথ বলে।
C4 উদ্ভিদে একই সাথে হ্যাচ ও স্ল্যাক চক্র এবং ক্যালভিন চক্র পরিচালিত হতে দেখা যায়। C3 উদ্ভিদের তুলনায় C4 উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণের হার বেশি এবং উৎপাদন ক্ষমতাও বেশি। সাধারণত ভুট্টা, আখ, অন্যান্য ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ, মুথা ঘাস, অ্যামারন্যথাস (Amaranthus-অ্যামারান্থাস) ইত্যাদি উদ্ভিদে পরিচালিত হয়।
৪। C3 ও C4 উদ্ভিদের মধ্যে পার্থক্য লিখুন ।
৫। CAM প্রক্রিয়া সম্পর্কে লিখুন।
CAM প্রক্রিয়া (CAM process)
ক্র্যাসুলেসিয়ান অ্যাসিড মেটাবলিজম সংক্ষেপে CAM প্রক্রিয়া বলা হয়। Crassulaceae গোত্রের (পাথরকুচি গোত্র) উদ্ভিদে এ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় বলে একে CAM নামকরণ করা হয়েছে। এসব উদ্ভিদ উষ্ণ আবহাওয়ায় বেঁচে থাকে। এসব উদ্ভিদে রাতে পত্ররন্ধগুলো খোলা থাকে। এর কারণ দিনের বেলায় এদের পাতায় জৈব অ্যাসিডের পরিমাণ কমে যায় যার ফলে pH এর মাত্রাও কমে যায় এবং রাতে জৈব অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় যার ফলে pH এর মাত্রা বেড়ে যায়।
৬। শ্বসন কাকে বলে ?
উত্তরঃ যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবকোষস্থ জটিল জৈবযৌগ (খাদ্যবস্তু) জারিত হয়, ফলে জৈবযৌগে সঞ্চিত স্থিতিশক্তি রূপান্তরিত হয়ে গতিশক্তি বা রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত হয়, তাকে শ্বসন (Respiration)বলে।
৭। শ্বসন কত প্রকার ও কী কী ?
উত্তরঃ
অবাত শ্বসন কাকে বলে?
উত্তর : যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে হয়ে থাকে তাকে অবাত শ্বসন বলে।
৮। সবাত শ্বসন কাকে বলে?
উত্তর : যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় এবং শ্বসনিক বস্তু জারিত হয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড, পানি ও বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে তাকে সবাত শ্বসন বলে।
৯। চক্রীয় ও অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন কাকে বলে ?
উত্তরঃ চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন (Cyclic Photophosphorylation) যে ফটোফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় আলোকশক্তি শোষণের ফলে উদ্দীপ্ত ক্লোরোফিল অণু থেকে নির্গত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে নিস্তেজ অবস্থায় পুনরায় ঐ ক্লোরোফিল অণুতে ফিরে আসে এবং একবার পরিভ্রমণ শেষে একটি ATP অণু তৈরি করে, তাকে চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন বলে।
অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন (Noncyclic Photophosphorylation)
যে ফটোফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় ক্লোরোফিল অণু থেকে উৎক্ষিপ্ত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার পর NADP-এর সাথে যুক্ত হয়, কিন্তু ইলেকট্রন যে ক্লোরোফিল থেকে নির্গত হয়েছিল সেই ক্লোরোফিলে পুনরায় ফিরে যায় না তাকে অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন বলা হয়।
১০। চক্রীয় ও অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন এর মধ্যে পার্থক্য লিখুন ।
উত্তরঃ
১১। সবাত ও অবাত শ্বসনের মধ্যে পার্থক্য লিখুন ।
সবাত শ্বসন ও অবাত শ্বসনের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-
১। সবাত শ্বসনে মুক্ত অক্সিজেনের (O2) উপস্থিতিতে ঘটে। অন্যদিকে অবাত শ্বসনে মুক্ত অক্সিজেনের অনপস্থিতিতে ঘটে।
২। সবাত শ্বসন বস্তু সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়। অন্যদিকে অবাত শ্বসন বস্তু আংশিক জারিত হয় ।
৩। সবাত শ্বসন বায়ুজীবি জীবে ঘটে । অন্যদিকে অবাদ শ্বসন অবায়ুজীবি জীবে ঘটে ।
৪। সবাত শ্বসন প্রান্তীয় হাইড্রোজেন গ্রাহক হল আণবিক অক্সিজেন । অন্যদিকে অবাত শ্বসন প্রান্তীয় হাইড্রোজেন গ্রাহক অক্সিজেনযুক্ত যৌগের অক্সিজেন।
৫। সবাত শ্বসনের উপজাত বস্তু CO2 ও H2O । অন্যদিকে উপজাত বস্তু CO2, H2O এবং অন্যান্য বস্তু।
৬। সবাত শ্বসন সম্পূর্ণ শক্তি অর্থাৎ 686 Kcal শক্তি উৎপন্ন হয় । অন্যদিকে অবাত শ্বসন আংশিক শক্তি অর্থাৎ 50 Kcal শক্তি উৎপন্ন হয়।
৭। সবাত শ্বসন প্রধানত তিনটি পর্যায়ে হয় -গ্লাইকোলাইসিস, ক্রেবস চক্র এবং প্রান্তীয় শ্বসন । অন্যদিকে অবাত শ্বসন দুটি পর্যায়ে সম্পর্ণ হয় – গ্লাইকোলাইসিস এবং পাইরুভিক অ্যাসিডের অসম্পূর্ণ জারণ ।
৮। সবাত শ্বসন সাইটোপ্লাসম ও মাইট্রোকন্ড্রিয়ার মধ্যে ঘটে । অন্যদিকে অবাত শ্বসন মাইট্রোকন্ড্রিয়ার বাইরে অর্থাৎ সাইটোপ্লাসমে ঘটে।
১২। C3 ও C4 উদ্ভিদ এর মধ্যে পার্থক্য লিখুন।
১৩। আলোক পর্যায় ও অন্ধকার পর্যায়ের মধ্যে পার্থক্য লিখুন৷
১৪। ফার্মান্টেশন বা গাজন কী ?
উত্তরঃ ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন (Fermentation)
কোষের বাইরে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে জাইমেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে গ্লুকোজ অণু অসম্পূর্ণভাবে জারিত হয়ে ইথানল (অ্যালকোহল) বা ল্যাকটিক অ্যাসিড সৃষ্টি ও অল্প পরিমাণ শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ফার্মেন্টেশন বা গাজন বলে। কিছু ব্যাক্টেরিয়া ও এককোষী ঈস্টে ফার্মেন্টেশন ঘটে। বিজ্ঞানের যে শাখায় ফার্মেন্টেশন সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয় তাকে জাইমোলোজি (Zymology) বলে। এ প্রক্রিয়ায় অ্যালকোহল, মদ, পাউরুটি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
১৫। গ্লাইকোলাইসিস কাকে বলে ?
উত্তরঃ শ্বসনের যে সাধারণ পর্যায়ে কোষের সাইটোপ্লাজমে এক অণু গ্লুকোজ কয়েক রকম উৎসেচকের প্রভাবে আংশিকভাবে জারিত হয়ে দুই অণু পাইরুভিক অ্যাসিড (CH3COCOOH), 2 অণু ATP, 2 অণু NADH2 ও 2 অণু H2O উৎপন্ন করে তাকে গ্লাইকোলাইসিস বলে । গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) হচ্ছে জীবের সবাত ও অবাত উভয় প্রকার শ্বসনের প্রথম ধাপ।
১৫। ক্রেবস চক্র কাকে বলে ?
উত্তরঃ ক্রেবস চক্র (Krebs Cycle)
পাইরুভিক এসিড থেকে উৎপাদিত ২-কার্বন বিশিষ্ট যৌগ অ্যাসিটাইল Co-A একটি জটিল চক্রের মাধ্যমে জারিত হয়ে CO2 এবং পানি প্রস্তুত করে। এ চক্রটির বিশদ বিবরণ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের প্রাণরসায়নবিদ স্যার হ্যানস ক্রেবস (Sir Hans Adolf Krebs, 1900 – 1981) প্রদান করেছিলেন । এজন্য তাঁর নামানুসারে এ চক্রকে ক্রেবস চক্র বলা হয়। এ চক্রের প্রথম উৎপাদিত যৌগ সাইট্রিক এসিড হওয়ায় ক্রেবস চক্রকে সাইট্রিক এসিড চক্র (Citric Acid Cycle)-ও বলে। সাইট্রিক এসিডে তিনটি কার্বক্সিল -COOH) গ্রুপ থাকায় একে বর্তমানে ট্রাই কার্বক্সিলিক এসিড চক্র বা টিসিএ চক্র (Tricarboxylic Acid Cycle বা TCA Cycle) বলে। ক্রেবস চক্রের সমগ্র বিক্রিয়াগুলো মাইটোকন্ড্রিয়ার মাতৃকার মধ্যে সম্পন্ন হয়। প্রকৃতপক্ষে, পাইরুভিক এসিডের সবাত জারণ (Aerobic Oxidation of Pyruvic Acid) ক্রেবস চক্রের মাধ্যমেই ঘটে